২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা ও তৎজনিত পরিস্থিতি এবং লকডাউনের জন্য স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে আজও। করোনার খবর ছড়াবার আগে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল "নো এনআরসি মুভমেন্ট" বা এনআরসি বিরোধী আন্দোলন, যা এখনো চলমান। ২০১৯ সালে কেন্দ্রে দ্বিতীয়বার নরেন্দ্র মোদির সরকার গঠনের পর সক্রিয়ভাবে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী চালু হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তার সাথেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল প্রস্তাবিত হয়। একই সালে অসমে সংগঠিত এনআরসিতে প্রায় ১৯ লাখ মানুষের নাম নাগরিক তালিকা থেকে বাদ গেছে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণ সংগঠন, ছাত্র সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল এনআরসি এবং সিএএ-র বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছেন ; সর্বোপরি প্রতিবাদে সরব হয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। এত আন্দোলন সত্ত্বেও ২০১৯ এর ১১ই ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয় এবং ১২ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৯ -এ পরিণত হয়। ইতিপূর্বেই সরকার ও বিরোধী বিভিন্ন দলগুলো নিজেদের স্বার্থে উক্ত বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করেছে, যাতে সমস্যায় পরছেন সাধারণ মানুষ।
এবার স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এনআরসি কী? সিএএ কী? এবং এর বিরোধিতাই বা কেন করা হচ্ছে? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে অতীতে।
১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে দেশে সংবিধান কার্যকরী হয়। এর পর থেকে বারবার সংবিধানের মূল কাঠামো এক রেখে, অন্যান্য বিষয়ে সংযোজন, কাটছাট চলেছে বিভিন্ন আইনের। সেরকমই এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন, যা দেশের নাগরিকত্বকে সংজ্ঞায়িত করে, সেটাই হলো ১৯৫৫ সালে পাস হওয়া নাগরিকত্ব আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫৫ (সিএ ১৯৫৫)। এই আইন অনুসারে, পাঁচ ধরণের মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ায় অসুবিধা নেই —
১) উক্ত ব্যক্তির জন্ম ভারতে হলে, ২) উক্ত ব্যক্তির বাবা মা দেশের নাগরিক হলে, ৩) নাগরিকত্বের আবেদন করলে, ৪) ন্যাচারালাইজেশন বা স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে (অর্থাৎ যাঁরা আইনত নাগরিক না হলেও, বহুবছর থাকার ফলে দেশের সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমস্ত কিছুর সাথেই মিশে গেছেন), ৫) ইনকরপোরেশন অফ টেরিটরির মাধ্যমে, অর্থাৎ কোনো জায়গা পরবর্তীতে দেশে অন্তর্ভুক্ত হলে, সেই এলাকার প্রত্যেকে ভারতীয় নাগরিক হবে। অতএব, ১৯৫৫ এর নাগরিকত্ব আইন জন্মগত নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকার করছে।
পরে বিভিন্ন সরকারের আমলে অন্যান্য আইনের মত সিএ, ১৯৫৫ -এরও সংশোধনী আনা হয়েছে এবং প্রায় প্রত্যেকবারই নাগরিকত্বের অবকাশ হয়েছে সংকীর্ণতর। ১৯৮৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই পর্যন্ত জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে।
পরবর্তী সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত সংশোধনীটি হল ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৩ (সিএএ ২০০৩)। এখানেই প্রথম নাগরিকত্বের প্রশ্নে এনআরআইসি (ন্যাশনাল রেজিষ্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস)-র মাধ্যমে ইললিগ্যাল মাইগ্রেন্ট বা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত এবং তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের কথা বলে। বাতিল এই আইনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই থেকে সিএএ ২০০৩ কার্যকর হওয়ার দিন ২০০৪ সালের ৩ রা ডিসেম্বর পর্যন্ত জন্মানো ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে তার বাবা বা মায়ের একজন ভারতীয় নাগরিক ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন। তাহলেই তিনি ভারতের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত হবেন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে,, যাদের সিঙ্গেল পারেন্ট বা যারা অনাথ আশ্রমে পালিত, তারা কীভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করবে? তাছাড়াও দেশের এক বিরাট অংশের মানুষ বন্যা, ধস, দুর্যোগ কবলিত উপকূলীয়, পাহাড়, জঙ্গল প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করেন, যেখানে প্রতিদিন জীবন হাতে নিয়ে বাঁচা, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের উপযুক্ত কাগজ কীভাবে তাদের সংগ্রহে থাকবে? যাঁরা উদ্বাস্তু, তাঁরা কাগজ কোথায় পাবেন?
সিএ ১৯৫৫ -এর এই সংশোধনীতে "১৪ক" ধারা যুক্ত করা হয়, যার দ্বারা সরকার দেশজুড়ে এনআরআইসি করার ক্ষমতা পায়। এর মাধ্যমে পূর্বোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে নাগরিকপঞ্জী তৈরি করবে সরকারি আধিকারিকেরা। প্রসঙ্গত, এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিষ্টার অফ সিটিজেনস) এবং এনআরআইসি প্রায় একই ব্যাপার। পার্থক্য শুধুমাত্র, এনআরআইসি দেশব্যাপী নাগরিকপঞ্জী তৈরির প্রক্রিয়া ও এনআরসি হল একটি বিশেষ স্থানের নাগরিকপঞ্জীর তৈয়ারী (যেমন, ২০১৯ সালে অসমের ঘটনাটি)।
সিএএ ২০০৩ ছড়ায় সেই সম্বন্ধীয় বিভিন্ন নিয়মাবলী সংকলিত হয় সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেনস অ্যান্ড ইস্যু অফ ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড) রুলস ২০০৩ -এ। এর ৩ নাম্বার রুলে হলো এনআরআইসি তৈরির নিয়ম রয়েছে। উক্ত রুলের (৪) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার এই (নাগরিক পঞ্জী) বিষয়ে নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে তার মধ্যে স্থানীয় রেজিস্টারের এক্তিয়ারে বসবাসকারী ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে "পপুলেশন রেজিস্টার" তৈরি করতে পারে। উক্ত রুলের (৫) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, পপুলেশন রেজিস্টারের প্রত্যেক ব্যক্তির তথ্য যাচাই করে "লোকাল রেজিস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস" অর্থাৎ স্থানীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করা হবে। এখানে চলে আসে জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিষ্টার অথবা সংক্ষেপে এনপিআরের প্রসঙ্গ।
পূর্বে বলা সিটিজেনশিপ রুলস ২০০৩ -এর ৪ নাম্বার রুলের (৩) ও (৪) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, পপুলেশন রেজিস্টারের প্রত্যেক ব্যক্তির তথ্য স্থানীয় রেজিস্টার দ্বারা যাচাই করা হবে। যাচাইয়ের সময়ে যাদের "সন্দেহজনক নাগরিক" বলে মনে হবে, স্থানীয় রেজিস্টার তাদের বিষয়ে পপুলেশন রেজিস্টারে উল্লেখ করবেন। সেই বিষয়ে তদন্ত করা হবে ও সেই ব্যক্তিকে এব্যাপারে জানানো হবে।
এনপিআরে নথিভুক্ত করা হবে, আধার নাম্বার, বাবা মায়ের তথ্য, তাঁদের জন্মানোর স্থান- কাল জানাতে হবে। সমস্যার বিষয় হলো, "সন্দেহজনক নাগরিক" দাগানো এড়াতে কোন কোন তথ্য দেওয়া আবশ্যিক, তা সিটিজেনশিপ রুলস ২০০৩ -এ উল্লেখ নেই। অতএব, বোঝা যাচ্ছে এই "সন্দেহজনক" তকমার ব্যাপারটি একান্তই রেজিস্টার বা তৎস্থানীয় আধিকারিকের হাতে, যেখানে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় রয়েছে। আবার এদিকে, আধার কার্ডের সাথে আমাদের বায়োমেট্রিক্স অর্থাৎ আঙ্গুলের ছাপের তথ্য থাকে, যা এনপিআরে সংগ্রহ করা হবে। কেন্দ্রের উদ্যোগে প্যান কার্ড, মোবাইল সিম, ভোটার কার্ড প্রভৃতি সবকিছুর সাথেই আধারের সংযোগ করা হচ্ছে। এর ফলে যে কোনো ব্যক্তি চব্বিশ ঘন্টা রাষ্ট্রের নজরদারিতে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
জানা যাচ্ছে, এনপিআর ও জনগণনা একই সাথে করার কথা হয়েছে, যা একজন সরকারি আধিকারিক কর্তৃকই সম্পন্ন হবে। অর্থাৎ, অজ্ঞাতসারেই একজন ব্যক্তি তাঁর তথ্য দিতে বাধ্য হবেন।
প্রসঙ্গত এনপিআর কিন্তু নতুন ব্যাপার নয়, সিএ ১৯৫৫ -তেও এর উল্লেখ আছে। যদিও এবারের এনপিআর আসলেই এনআরসির পূর্বধাপ।
উল্লেখ্য, ২০১৯ -এ অসমে ঘটা এনআরসির আগে এনপিআর করা হয়নি। "আসাম পাবলিক ওয়ার্কস" নামের সংস্থার পক্ষ থেকে ২০০৯ সালে আবেদন করা হয় আ অসমে নাগরিক পঞ্জী আপডেট করার, যার ভিত্তিতে ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট তা করতে অর্ডার দেয়। "আসাম অ্যাকর্ড" অনুযায়ী (যা, সিএ ১৯৫৫ -এর ৬ক ধারা হিসাবে যুক্ত করা হয়েছিল), অসমের কাট অফ ডেট ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ। অর্থাৎ অসমের মানুষদের প্রমাণ করতে হয়েছে, "কাট অফ ডেট" অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের আগে থেকেই তাঁরা বা তাঁদের পূর্বপুরুষ ভারতের নাগরিক। এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় ১৪টি নথিকে তালিকা ক -তে এবং ৮ টি নথিকে তালিকা খ -তে (যদি তালিকা ক'র নথিগুলি পূর্বপুরুষের হয়ে থাকে, তবে নিজের জন্য এই নথি প্রয়োজন) ভাগ করা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও, অসমে ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্ব হারায়, তাদের মধ্যে ১৪ লক্ষ হিন্দু।
ধারণা করা হচ্ছে, সমগ্র ভারতে যদি এনআরআইসি করা হয়, সেক্ষেত্রে এই কাট অফ ডেট হবে ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাই। কারণ, সংবিধানের ৬ নাম্বার ধারায় বলা হচ্ছে, যাঁরা ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাইয়ের পরে ভারতে এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে নাগরিকত্বের আবেদন করতে হবে। আর এর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশে নাগরিক পঞ্জী গঠনের কাজে এই তারিখটি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
এবার আসা যাক, সিএএ ২০১৯ প্রসঙ্গে। এই সিএএ ২০০৩ -এর পরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকত্ব আইন। কেন্দ্রীয় সরকারের নিজস্ব সংবাদপত্র "দি গেজেট অফ ইন্ডিয়া"তে এই আইনটি প্রকাশ করেছেন ভারত সরকারের সচিব ডাঃ জি. নারায়ণ রাজু। ১০ই জানুয়ারি, ২০২০ তারিখ থেকে এই আইন লাগু হয়েছে।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এই সিএএ আসলে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, আক্ষরিকভাবে তা সত্যিও। সিএএ ২০১৯ আইনটিতে নাগরিকত্বের আবেদন করার ভিত্তিতে (অতএব এনআরসিতে যারা নাগরিকত্ব হারাবেন, তাদের আবেদনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) কারা নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য হবে, সে বিষয়ক। এই আইনের নব্য সংশোধনীগুলি হলো—
১) এই আইনে সিএ ১৯৫৫-এর ২ নাম্বার ধারার (১) নাম্বার উপধারার (খ) শর্তে যুক্ত করা নিয়মটি হলো —
"আফগানিস্তান, বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের কোন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান মানুষ, যারা ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৪ -র আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন, এবং যাদেরকে কেন্দ্র সরকার দ্বারা বা পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন ১৯২০-র ৩ নাম্বার ধারার (২) উপধারায় (গ) শর্ত অনুযায়ী অথবা বিদেশী আইন ১৯৪৬ (ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬)-এর নিয়ম প্রযুক্ত করে বা এদের অন্তর্ভুক্ত কোন নিয়ম বা আদেশ জারি করে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে এই আইনের আওতায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে না।"
২) এক্ষেত্রে মূল আইন সিএ ১৯৫৫-য় ৬খ ধারার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। এতে বলা হয়, অসম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরার উপজাতি অঞ্চল এবং বঙ্গীয় পূর্ব সীমান্ত বিধেয়ক ১৮৭৩-এ নির্দেশিত অন্তর্বর্তী সীমা অঞ্চল বাদে দেশের অন্য স্থানে যদি পূর্বোক্ত নাম্বার ধারার (১) নাম্বার উপধারার (খ) শর্তে উল্লিখিত ব্যক্তির নাগরিকত্বের আবেদন কেন্দ্র সরকার বা তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সমস্ত নিয়ম মেনে নথিভুক্তির শংসাপত্র বা স্বাভাবিকীকরণের শংসাপত্র দিতে পারেন। সমস্ত শর্ত মেনে শংসাপত্র পাওয়ার দিন থেকেই সেই ব্যক্তি ভারতের প্রবেশের দিন থেকেই নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন এবং এই আইন জারির দিন থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব বা অবৈধ অনুপ্রবেশ বিষয়ক যেকোনো মামলা মকুব হয়ে যাবে। কোনো ব্যক্তি উক্ত ধরণের মামলা চলার কারণে নাগরিকত্বের আবেদন করতে অক্ষম হবেন না এবং আবেদন করলেও (অর্থাৎ নিজের বর্তমান নাগরিকত্বকে অস্বীকার করা) আগের সমস্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা তিনি যেমন পেতেন তেমনি পাবেন। উল্লেখ্য, এখানে "অন্তর্বর্তী সীমা"(ইনার লাইন) বলতে বোঝায় ভারত সরকার দ্বারা বিশেষভাবে সুরক্ষিত অঞ্চলগুলিকে, যেসব অঞ্চলে যেতে গেলে যে কোনো সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের "ইনার লাইন পারমিট" নামক বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন।
৩) এই আইনের ৭ঘ ধারার সংশোধনী অনুযায়ী, ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিদেশী নাগরিক ভারতের কোনো আইন লঙ্ঘন করলে, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এই আইন দ্বারা কোনো আদেশ জারি করা যাবে না।
৪) আইনের ১৮ নাম্বার ধারার সংশোধনীতে, এই ধারার (২) নাম্বার উপধারায় (গগ) শর্তের পরে (গগঝ) শর্ত যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হচ্ছে, নথিভুক্তির শংসাপত্র বা স্বাভাবিকীকরণের শংসাপত্র দেওয়ার শর্ত, বিধিনিষেধ ও উপায় ৬খ ধারার (১) নাম্বার উপধারা অনুসারে হবে।
৫) শেষত, আইনের তৃতীয় ভাগের (ঘ) শর্তে সংযুক্ত হওয়া নিয়মে বলা হল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে, উক্ত শর্তের হিসেবে, ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণের জন্য ভারতে বসবাসের বা চাকরির প্রামাণ্য মেয়াদ এগারো বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হলো। অর্থাৎ সেই ব্যক্তি পাঁচ বছর (৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ -র আগে থেকে) দেশে রয়েছে বা চাকরির সাথে যুক্ত, তা প্রমাণ করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এনআরসি করার কথা বলা হয়েছে সিএএ ২০০৩ -এ, সিএএ ২০১৯ -এ নয়। সুতরাং, যারা এনআরসি ও সিএএ ২০১৯ -এর বিরোধিতা করছেন, তাদের উচিত সমভাবে সিএএ ২০০৩ -এরও বিরোধিতা, কারণ এনআরসির মূল এই আইনই।
ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সিএএ ২০১৯ -তে মাত্র ৩১৩১৩ জনই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। বাকিরা আবেদনও করতে পারবে না। সেই ৩১৩১৩ জনকে হতে হবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান — এই ৬টি ধর্মের মানুষ, যারা ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য এদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তারা এদেশে এসে সে বিষয়ে সরকারকে না জানালে, তাদের সিএএ ২০১৯ দ্বারা নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। যারা তাদের এদেশে আসার কথা জানাবেন, সেই ৩১৩১৩ জনকে "রেজিস্টার্ড রিফিউজি" বলা হচ্ছে। যদিও তাদের প্রত্যেকেই যে নাগরিকত্ব পাবেন, এমনটাও আশা করা যায় না। কারণটা বলি তাহলে।
কারোর এনআরসিতে নাম বাদ যাবার দিন থেকে (অর্থাৎ নাগরিক পঞ্জী প্রকাশিত হওয়ার দিন থেকে, যাতে সেই ব্যক্তির নাম নেই) ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিজেকে ভারতীয়ত্ব দাবি করতে হবে। এ জন্য তাকে দ্বারস্থ হতে হবে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে, যা একজন সাধারণের মানুষের জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য। প্রমাণ স্বরূপ তাকে পূর্বোক্ত ৬টি ধর্মের একটির অনুসারী হতে হবে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সংখ্যাগুরু (মুসলিম) দ্বারা নির্যাতিত হয়ে যে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন তাদের ওই দেশের এফআইআরের কপি বা অন্য লিখিত প্রমাণ দেখাতে হবে, যে তাদের ওপর সংখ্যাগুরু দ্বারা অত্যাচার করা হয়েছে। এরপর সেই তথ্যের যাচাই করবে আরএডব্লিউ (র), ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল প্রভৃতি ইন্টেলিজেন্স। তারা নিজেদের কূটনৈতিক চর দ্বারা উক্ত দেশে গিয়ে যাচাই করবে, নাগরিকত্বের আবেদনকারী ব্যক্তির প্রদান করা তথ্য ও ঘটনার উল্লেখ সঠিক কি না! তারপর যদি প্রমাণিত হয় ব্যক্তির তথ্য সঠিক, তবে তিনি নাগরিকত্বের ছাড় পাবেন। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, অত্যন্ত দীর্ঘ এই প্রক্রিয়া।
এতক্ষণ আমরা দেখলাম, নাগরিকত্ব পাওয়ার লড়াইয়ের কথা। স্পষ্টত বোঝা গেল, সিএএ ২০১৯ আইনে সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্বের আবেদনের ব্যাপারটা বিশেষভাবে অনুল্লিখিত থাকলেও, বিপদে পরবেন সমস্ত ধর্মের মানুষ, যে বিষয়ে সতর্ক আমাদের প্রত্যেককেই হতে হবে। শুধু অসমে ১৯ লাখ মানুষের নাম এনআরসি থেকে বাদ গেছে, সেখানে দেশব্যাপী এনআরআইসি হলে অথবা কোনো রাজ্যে/জোনে এনআরসি হলে, কত মানুষের নাম বাদ যাবে তার একটা ধারণা করতেই পারি। আর সেই বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে মুসলিম বাদে আবেদনই করতে পারবেন না ৩১৩১৩ জনের বেশি, যাদের আবার প্রত্যেকে নাগরিকত্ব পাবে কি না, যথেষ্ট সংশয়ের।
এবার, আইনের মারপ্যাঁচে যারা বাদ গেলেন বা যাবেন, তাদের ঠাঁই কী হবে? তাদের থাকতে হবে ডিটেনশন সেন্টারে, যতদিন না সেই ব্যক্তিকে কোনো দেশ নিজের অধিবাসী হিসাবে শংসাপত্র দিচ্ছে। আর এই বিশাল সংখ্যক মানুষ দায় কি অন্য দেশ নেবে? শেখ হাসিনা তো পরিষ্কার জানিয়েই দিয়েছেন, বাংলাদেশের কেউ ভারতে প্রবেশ করেনি, অর্থাৎ এত মানুষের দায় তারা নেবেইনা। তাহলে, তাদের কি সারাজীবনের জন্য ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী হয়ে থাকতে হবে?
ডিটেনশন সেন্টারের প্রসঙ্গ কেন এলো, তা আলোচনা করা যাক। কোনো নাগরিকত্ব আইনেই বলা নেই, এনআরসিতে বাদ পরা মানুষের, যারা অবৈধ নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত হবেন, তাদের পরিণতি কী হবে! তাই ভারতীয় আইনসমূহের অন্য দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। তা সেই আইন হচ্ছে, পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন, ১৯২০ এবং বিদেশী আইন, ১৯৪৬। পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন, ১৯২০ -এর ৫ নাম্বার ধারা অনুযায়ী, ভারতের নাগরিক নয় এমন কোনো ব্যক্তির যদি বৈধ পাসপোর্ট না থাকে, অথবা পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে এবং তা পুনর্নবীকরণ করা না হয়ে থাকে, তবে সেই ব্যক্তি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। বিদেশী আইন, ১৯৪৬ -এর ৩ নাম্বার ধারার (২) উপধারার (ঙ) শর্তে বলছে, দেশে থাকা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত ব্যক্তি নির্দিষ্ট স্থানে সরকার আরোপিত সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে আটক থাকতে বাধ্য হবে। তার সমস্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, যেমন পরিচয়, স্বাক্ষর, আঙ্গুলের ছাপ (বায়োমেট্রিক্স), ছবি ইত্যাদি সবকিছুই সরকারকে জানাতে বাধ্য থাকবে। সে সরকার কর্তৃক মেডিকেল পরীক্ষা করাতে বাধ্য হবে। সে সরকার নিষিদ্ধ ব্যক্তি বা কাজ বা জিনিসের সাথে সংশ্রব না রাখতে বাধ্য থাকবে। পক্ষান্তরে, তার সমস্ত গতিবিধির ওপরই নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আর এখান থেকেই আসে ডিটেনশন সেন্টারের ধারণা, যা আসলে কিছু সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত বৃহৎ জেলখানা ছাড়া অন্য কিছু না।
যেহেতু, এনআরসিতে বাদ পরা মানুষ নাগরিক বলে গণ্য হবে না, বরং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তকমা জুটবে তাদের, তাই তাদের ঠিকানা হবে ডিটেনশন সেন্টার। ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে সরকারের তরফে জানানো হয়, অসমে গোলপাড়া, ডিব্রুগড়, শিলচর, তেজপুর, জোরহাট, কোকরাঝাড় — এই ৬টি জায়গার ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে ১০৪৩ জনকে। কেরালায় তৈরি হচ্ছে ডিটেনশন সেন্টার। আসলে কেন্দ্র যদি এনআরসি তৈরীর নির্দেশ দেয়, যে কোনো রাজ্য সরকারই তা মানতে বাধ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে কোনও রাজ্য কোনো প্রস্তাব নিয়ে এলে, তা হবে অসাংবিধানিক। স্বভাবতই বিভিন্ন রাজ্য ডিটেনশন সেন্টার বানাবার চেষ্টাতেই আছে। ফলে আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে, এনআরসি চালু হতে দেরি নাই। এত কিছুর মধ্যে সমস্যা হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দ্বারা এখনো বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়নি এবারের এনআরসিতে নাম তোলার জন্য কী কী তথ্য লাগবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সরকারি নির্দেশের।
সুতরাং ক্রমানুযায়ী একবার রিপিট করা যাক লেখার বিষয়বস্তু। সিএএ ২০০৩ আইনে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর কথা রয়েছে। এনআরসির আগে এনআরপি বা জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন তৈরি হবে, যেখানে দেশের সমস্ত ব্যক্তির তথ্য নেওয়া হবে। তারপর সরকারি আধিকারিক দ্বারা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের নোটিশ পাঠানো হবে সরকার নির্দিষ্ট তথ্যাদি জমা করে প্রমাণ করতে হবে সেই ব্যক্তি অথবা তার পূর্বপুরুষ ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাইয়ের আগে দেশে এসেছেন। এই সমস্ত নথি বিশ্লেষণ করে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী প্রকাশ হবে। তাতে যাদের নাম বাদ যাবে, তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে, যে তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান ধর্মের) এবং সেই দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এদেশে আসার লিখিত প্রমাণ দেখাতে হবে। এই আবেদন করতে পারবেন ৩১৩১৩ জন। প্রমাণসমুহ ইন্টেলিজেন্স দ্বারা সেদেশে গিয়ে যাচাই করা হবে। এর পরেও যারা নাগরিকত্বের ছাড় পাবেন না, তাদের ঠিকানা ডিটেনশন ক্যাম্প।
প্রশ্ন আসে, এতকিছু করার কারণ কী? সরকারে থাকা লোকজন বলছে, "বহিরাগত", "অনুপ্রবেশকারী"দের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে নাকি এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাতে সুযোগ সুবিধা শুধু দেশের লোক পায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই কি তাই? এতদিনের যে নাগরিক কোনো কারণে নথি জোগাড় করতে পারেনি বা সব নথি দেওয়ার পরও যার নাম বাদ গেল এনআরসিতে, যাদের পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এবং ভবিষ্যতে যাদের এরকম ঘটবে, তাদের দায় কে নেবে? নাকি শুধু সবটাই কর্পোরেট স্বার্থে সস্তা শ্রমিক তৈরির প্রক্রিয়া? এনআরসি, সিএএ ২০০৩ ও সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনকে তীব্রতর করতে হবে সাধারণ মানুষের স্বার্থে। যতদিন না এই জনবিরোধী আইনগুলো বাতিল হচ্ছে, ততদিন মানুষের মাথার ওপর নাগরিকত্ব হারানোর খাঁড়া খুলতেই থাকবে।
আশা করি, লেখাটি বিভ্রান্তি দূর করতে কাজে আসবে। লেখায় কোনো ভুল থাকলে অবশ্যই জানাবেন। লিখতে গিয়ে সাহায্য নিয়েছি অভিষেক দে দা, মাসিদুর রহমান দা, সব্যসাচী মুখার্জি দা এবং আরও অনেকের কাছে, প্রত্যেককে অবশ্য ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্রঃ–
১)CA 1955 https://www.tiss.edu/uploads/files/Citizenship_Act_1955.pdf&ved=2ahUKEwiuufLsjNbzAhXSyzgGHX3WCQsQFnoECAYQAQ&usg=AOvVaw0OSVMwxaKaKRw0wliF9gO3)
২) CAA 2003 (https://egazette.nic.in/WriteReadData/2004/E_7_2011_119.pdf&ved=2ahUKEwiUhMC6jNbzAhXGfX0KHXb2AiMQFnoECAYQAQ&usg=AOvVaw3HEMnIPp6gTHP7YPkdiSAP)
৩) CAA 2019 (https://egazette.nic.in/WriteReadData/2019/214646.pdf&ved=2ahUKEwjJjtWFjNbzAhVEb30KHXjoDBIQFnoECAMQAQ&usg=AOvVaw0NLqZ7NbWW-sXe1LSfFMBl)
৪) Citizenship Rules, 2003 (https://drive.google.com/file/d/1GRr0YEJ5Ouj03GKJR5ZOR4ie9XoojHTq/view)
৫) Foreigners Act, 1946 (https://legislative.gov.in/sites/default/files/A1946-31.pdf&ved=2ahUKEwik6Or0jtbzAhU3wjgGHRFxClYQFnoECAoQAQ&usg=AOvVaw0lIoWd8Cd4aAVryywGGuuO)
৬) The Passport (Entry Into India) Act, 1920 (https://www.mha.gov.in/PDF_Other/act1920_17042017.pdf&ved=2ahUKEwict6e5j9bzAhVKWysKHUqNAYUQFnoECAcQAQ&usg=AOvVaw3b-xdEGxqKmLHMWolpMTgi)
Email — swarnavabhattacharya9@gmail.com